ইসলামী সাহিত্যের নিদর্শন

Image
ইসলামী সাহিত্যের নিদর্শন ইসলামী দাওয়াত প্রথম দিন থেকেই সঠিক বিপ্লবের রূপে আত্মপ্রকাশ করে। চিন্তার মোড় ফিরিয়ে দেয়া, কথা ও কাজের ধারার পরিবর্তন করা এবং সমাজ কাঠামো বদলে দেয়াই হয় তার লক্ষ্য। সাহিত্যের যে ধারা জাহেলী যুগ থেকে চলে আসছিল ইসলাম এসে তার খোল নলচে পাল্টে দেয়। জাহেলী যুগের কবিদের সম্পর্কে কুরআনের সূরা আশ শূ’আরায় বলা হয়: ওয়াশ শু’আরাউ ইয়াত্তাবিউ হুমুল গবূন, আলাম তারা আন্নাহুম ফী কুল্লি ওয়াদিঁই ইয়াহীমূন, ওয়া আন্নাহুম ইয়াকূলূনা মা-লাইয়াফআলূন – “আর কবিরা! ওদের পেছনে তো চলে পথভ্রষ্ট যারা, দেখছোনা তারা মাথা খুঁড়ে ফেরে প্রতি ময়দানে আর বলে বেড়ায় যা করে না তাই।“ এভাবে জাহেলী যুগের সাহিত্য চিন্তার মূলধারাকে ইসলাম ভ্রষ্টতার আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে। জাহেলী যুগের সাহিত্য চিন্তা কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিসারী ছিল না। বিভ্রান্ত চিন্তার বিভিন্ন অলিতে গলিতে সে চিন্তা ছুটে বেড়াতো। চিন্তার স্থিরতার মাধ্যমে জীবনকে কোন এক লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব সেখানে নেয়া হয়নি। তাই জাহেলী যুগের কবিদের কথা ও কাজের কোন মিল ছিল না। বড় বড় বুলি আওড়ানোই ছিল তাদের পেশা। সেই অনুযায়ী কাজ করা বা নিজেদের দাবী অনুযায়ী ...

হযরত আবু বকর সিদ্দিকের ইন্তেকাল

 হযরত আবু বকর সিদ্দিকের ইন্তেকাল


হযরত আবু বরক সিদ্দিক (রা) রসূলে খোদার (সা) ইন্তেকালের পর মাত্র দুই বৎসর তিন মাস জীবিত ছিলেন। হযরত ইবনে ওমর (রা) বলেন, “রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের বিরহ-ব্যথা তিনি সহ্য করিতে পারেন নাই। দিন দিনই কৃশ-দুর্বল হইয়া যাইতেছিলেন। এইভাবেই তিনি দুনিয়া হইতে শেষ বিদায় গ্রহণ করেন।” রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর তিনিই সকলকে সান্ত্বনার বাণী শুনাইয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার নিজ অন্তরের দাহ একটুও শান্ত হয় নাই। একদিন বৃক্ষ শাখে একটি পাখীকে নাচিয়া বেড়াইতে দেখিয়া একটু উত্তপ্ত দীর্ঘ নিঃশ্বাস সহকারে বলিতে লাগিলেন, “হে পাখী, কত ভাগ্যবান তুমি। গাছের ফল খাও আর শীতল ছায়ায় আনন্দে কালাতিপাত কর। মৃত্যুর পরও তুমি এমন স্থানে যাইবে, যেখানে কোন প্রকার জবাবদিহির দায়িত্ব নাই। পরিতাপ! আবু বকরও যদি এমন ভাগ্যবান হইত!” কখনও কখনও বলিতেন “আফসোস! আমি যদি তৃণ হইতাম আর চতুষ্পদ জন্তু আমাকে খাইয়া ফেলিত।” এই সমস্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত উক্তি হইতে অনুমান করা যায়, রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের চির-বিদায়ের পর হযরত আবু বকরের হৃদয়ের ব্যথা কতটুকু উৎকট হইয়া উঠিয়াছিল।


পীড়ার সূচনা


ইবনে হেশাম বলেন, হযরত সিদ্দিকে আকবরের নিকট কিছু গোশ্‌ত উপহার আসিয়াছিল। তিনি হাঁরেস ইবনে কালদাসহ তাহা খাইতেছিলেন। এমতাবস্থায় হারেস বলিলেন- “আমীরুল মোমেনীন, আর খাইবেন না। আমার মনে হয় উহাতে বিষ মিশ্রিত রহিয়াছে।” সঙ্গে সঙ্গেই তিনি খাওয়া বন্ধ করিয়া দিলেন, কিন্তু এই দিন হইতেই তাঁহারা উভয়ে পীড়া অনুভব করিতে শুরু করেন। হিজরী ১৩ সালের ৭ই জুমাদাল উখরা সোমবার দিন তিনি গোসল করিয়াছিলেন। ইহাতেই ঠান্ডা লাগিয়া জ্বর শুরু হইল। এই জ্বর আর সারিল না। শরীরে যে পর্যন্ত শক্তি ছিল রীতিমত মসজিদে আসিয়া নামায পড়াইতে ছিলেন, কিন্তু রোগ যখন তীব্র হইয়া উঠিল, তখন হযরত ওমরকে ডাকাইয়া বলিলেন, “এখন হইতে আপনি নামায পড়াইতে থাকিবেন।”


কোন কোন সাহাবী আসিয়া বলিলেন, “যদি অনুমতি দেন তবে চিকিৎসক ডাকিয়া আপনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি।” জওয়াব দিলেন, চিকিৎসক আমাকে দেখিয়া ফেলিয়াছেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি কি বলিলেন? হযরত সিদ্দিক বলিলেন,---- فَعَّالٌ لِّمَا يُرِيدُ


তিনি বলিয়াছেন, “আমি যাহা চাই তাহাই করি।”- (কোরআন)হযরত ওমরের নির্বাচন


শরীর যখন খুব বেশী দুর্বল হইয়া গেল, তখন রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের খলিফা নির্বাচনের কথা বিশেষভাবে ভাবিতে শুরু করিলেন। তিনি চাইতেন মুসলমানগণ যেন যে কোন প্রকার আত্মকলহ হইতে বাঁচিয়া থাকিতে পারে। এই জন্য তিনি বিশেষ চিন্তাশীল সাহাবীগণের মতামত গ্রহণ করতঃ নিজেই খলিফার নাম প্রস্তাব করার মনস্থ করিলেন। প্রথম তিনি আবদুর রহমান ইবনে আউফকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ওমর সম্পর্কে আপনার মতামত কি? তিনি বলিলেন, আপনি তাঁহার সম্পর্কে যত ভাল ধারণাই পোষণ করুন না কেন, আমার ধারণা তাহার চাইতেও ভাল। তবে তিন একটু কঠোর প্রকৃতির লোক। হযরত সিদ্দিক (রা) বলিলেন, তাঁহার কঠোরতা ছিল এই জন্য যে, আমি ছিলাম কোমল। যখন তাঁহার উপর দায়িত্ব আসিবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি কোমল হইয়া যাইবেন। এই কথা শুনিয়া হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) চলিয়া গেলেন। অতঃপর হযরত ওসমানকে ডাকাইয়া মতামত জিজ্ঞাসা করিলেন। হযরত ওসমান (রা) বলিলেন, আপনি আমার চাইতে ভাল জানেন। হযরত সিদ্দিক (রা) বলিলেন, তবুও আপনার মাতামত কি? জওয়াবে হযরত ওসমান (রা) বলিলেন, আমি এতটুকু বলিতে পারি, ওমরের বাহিরের চাইতে ভিতর অনেক ভাল এবং তাহার চাইতে যোগ্য ব্যক্তি এখন আমাদের মধ্যে আর কেহ নাই।


হযরত সাঈদ ইবনে যায়েদ এবং উসাইদ ইবনে হোযাইরের নিকটও অনুরূপভাবে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলেন। হযরত উসাইদ (রা) বলিলেন, “ওমরের অন্তর পবিত্র। তিনি সৎকর্মশীলদের বন্ধু ও অসৎদের শত্রু । আমি তাঁহার চাইতে শক্ত ও যোগ্য ব্যক্তি আর দেখিতেছি না।”


হযরত সিদ্দিক (রা) অনুরূপভাবে বহু লোকের নিকট হযরত ওমর (রা) সম্পর্কে মতামত গ্রহণ করিতেছিলেন। সমগ্র মদীনায় প্রচারিত হইয়া গিয়াছিল, হযরত আবু বকর (রা) হযরত ওমর (রা)- কে তাঁহার স্থলাভিষিক্ত করিতে চান। খবর শুনিয়া হযরত তালহা (রা) তাঁহার নিকট আগমন করিয়া বলিতে লাগিলেন, আপনি জানেন, আপনার জীবদ্দশায়ই ওমর (রা) লোকদের সহিত কত কঠোর ব্যবহার করেন, আর এখন যদি তিনি খলিফাই হইয়া যান তবে না জানি কি করিতে শুরু করেনঃ আপনি আল্লাহর দরবারে চলিয়া যাইতেছেন, ভাবিয়া দেখুন, আপনি আল্লাহর নিকট উহার কি জওয়াব দিবেন। হযরত সিদ্দিক (রা) বলিলেন, আমি খোদাকে বলিব “আমি তোমার বান্দাদের উপর ঐ ব্যক্তিকেই নিযুক্ত করিয়া আসিয়াছি, যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন।”অন্তিম উপদেশ ও দোয়া


অতঃপর তিনি হযরত ওমরকে নির্জনে ডাকিয়া কতগুলি প্রয়োজনীয় উপদেশ দিলেন এবং আল্লাহর দরবারে হাত উঠাইয়া বলিতে লাগিলেন:


“হে খোদা, আমি এই নির্বাচন এই জন্য করিয়াছি যেন মুসলমানদের মঙ্গল হয়। আমার ভয় ছিল, শেষ পর্যন্ত তাহারা আত্মকলহ ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হইয়া না যায়! হে প্রভু, আমি যাহা বলিতেছি তুমি তাহা ভালভাবেই জান। আমার চিন্তভাবনা এই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করিয়াছিল। এই জন্য আমি এমন এক ব্যক্তিকে আমীর নিযুক্ত করিয়াছি, যিনি সবচাইতে দৃঢ় ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এবং মুসলমানদের সবচাইতে বেশী হিতাকাঙ্ক্ষী। আয় আল্লাহ, আমি তোমার নির্দেশেই মর-দুনিয়া ত্যাগ করিতেছি। এখন তোমার বান্দারা তোমার হাতেই সমর্পিত হইতেছে। ইহারা তোমার বান্দা। ইহাদের ভাগ্যের ডোর তোমারই হাতে। হে আল্লাহ, মুসলমানদের জন্য সৎ শাসনকর্তা দাও। ওমরকে খলিফায়ে রাশেদীনের অন্তর্ভুক্ত কর এবং তাঁহার প্রজাদিগকে তাঁহার যোগ্যতা দ্বারা উপকৃত কর।”


হযরত আবু বকরের গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও বেলায়েতের মহৎ গুণেই খেলাফতের এই কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান হইয়া গেল। পূর্বাপর গোটা মুসলিম সমাজের অভিমত, হযরত ওমরকে খেলাফতের জন্য নির্বাচন ইসলাম ও মুসলিম জাতির জন্য হযরত আবু বকরের এমন এক বিরাট অবদান, কেয়ামত পর্যন্ত যাহার আর কোন নজির মিলিবে না। হযরত ওমর (রা) মাত্র কয়েক বৎসরের মধ্যেই যাহা করিয়াছিলেন, এক কথায় বলিতে গেলে, ইসলামের যে শক্তি ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন অবস্থায় বিদ্যমান ছিল, সেই সবগুলিকে সংহত করিয়া আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়াছিলেন।দুনিয়ার হিসাব নিকাশ


হযরত আয়েশা (রা) বলেন, হযরত সিদ্দিকে আকবর (রা) আমাকে বাগানের বিশ সের খেজুর দিয়াছিলেন, যখন তাঁহার রোগ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় তখন বলিতে লাগিলেন, প্রিয় বৎস, আমি সর্বাবস্থায়ই তোমাকে সুখী দেখিতে চাই। তোমাদের দারিদ্র্য দেখিয়া আমার দুঃখ হয়। তোমাদের স্বাচ্ছন্দ্য দেখিলে আমি আনন্দিত হই। বাগানের যে খেজুর তোমাকে দিয়াছিলাম, যদি তুমি তাহা লইয়া গিয়া থাক তবে ভাল, অন্যথায় আমার মৃত্যুর পরই উহা আমার পরিত্যক্ত সম্পত্তি বলিয়া গণ্য হইবে। তোমার আরও দুই ভাই-বোন রহিয়াছে। এমতাবস্থায় এই খেজুরগুলি কোরআনের নির্দেশ মোতাবেক নিজেদের মধ্যে বন্টন করিয়া নিও।


হযরত আয়েশা (রা) বলিলেন, “মাননীয় পিতা, আমি আপনার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করিব। ইহার চাইতে অধিক সম্পদও যদি হইত, তবুও আপনার নির্দেশমত তাহা আমি ত্যাগ করিতাম।”


মৃত্যুর কিছুক্ষণ পূর্বে বলিলেন, “বাইতুল মাল হইতে আমি এই পর্যন্ত যে পরিমাণ বৃত্তি গ্রহণ করিয়াছি, তাহার হিসাব কর।” হিসাব করার পর জানা গেল, গোটা খেলাফত আমলে মোট ছয় হাজার দেরহাম বা পনের শত টাকা গ্রহণ করিয়াছেন। বলিলেন, “আমার ভূমি বিক্রয় করিয়া এখনই এই অর্থ পরিশোধ করিয়া দাও।” তৎক্ষণাৎ ভূমি বিক্রয় করতঃ বাইতুল মালের টাকা পরিশোধ করিয়া দেওয়া হইল। এইভাবেই আহহাহর রসূলের হিজরতের বন্ধুর এক-একটি পশম বাইতুল মালের দায়িত্ব হইতে মুক্ত করা হইল। বাইতুল মালের টাকা পরিশোধ করার পর বলিলেন, “অনুসন্ধান করিয়া দেখ, খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আমারশেষ নিঃশ্বাসের সময়


হযরত আবু বকরের জীবনের শেষ দিন ইরাকে যুদ্ধরত মুসলিম বাহিনীর সহকারী সেনাপতি মুসান্না মদীনায় পৌঁছিলেন। এই সময় আমীরুল মোমেনীন মৃত্যু যন্ত্রণার চরম অবস্থা অতিক্রম করিতেছিলেন। মুসান্নার আগমন সংবাদ জানিতে পারিয়া তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। মুসান্না যুদ্ধক্ষেত্রের সকল খবর বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করিলেন এবং বলিলেন, “পারস্য সম্রাট কেসরা ইরাকে নূতন সৈন্য প্রেরণ করিয়াছেন।” সমস্ত খবর শুনিয়া এই অবস্থাতেই হযরত ওমরকে ডাকিয়া বলিলেন, “ওমর, আমি যাহা বলিতেছি, মনোযোগ দিয়া শ্রবণ কর এবং সেই অনুযায়ী কাজ কর। আমার মনে হয় অদ্যই আমার জীবন শেষ হইয়া যাইবে। যদি দিনের বেলায় আমার দম বাহির হয় তবে সন্ধ্যার পূর্বেই এবং যদি রাত্রে হয় তবে সকাল হওয়ার পূর্বেই মুসান্নার সহিত সৈন্য প্রেরণ করিবে।” অতঃপর বলিলেন, “ওমর, যে কোন বিপদ মুহূর্তেও আল্লাহর নির্দেশ অথবা ইসলামের কোন কাজ পরবর্তী দিবসের জন্য মুলতবি রাখিও না। হযরত রসূলুল্লাহ (সা)- এর মৃত্যুর চাইতে বড় বিপদ আমাদের জন্য আর কি হইতে পারিত? কিন্তু তুমি দেখিয়াছ, ঐ দিনও আমার যা করণীয় ছিল তাহা আমি করিয়াছি। আল্লাহর শপথ, ঐ দিন যদি আমি আল্লাহর নির্দেশ কার্যকর করিতে যাইয়া অবহেলা করিতাম, তবে আল্লাহ আমাদের উপর ধ্বংসের শাস্তি অবতীর্ণ করিতেন; মদীনার ঘরে ঘরে কলহের আগুন জ্বলিয়া উঠিত। আল্লাহ যদি ইরাকে মুসলিম বাহিনীকে কৃতকার্য করেন, তবে খালেদের বাহিনীকে সিরিয়া সীমান্তে পাঠাইয়া দিও। কেননা, সে বিচক্ষণ এবং ইরাকের অবস্থা সম্পর্কে বিশেষভাবে অভিজ্ঞ ব্যক্তি।”


ইন্তেকালের সময় হযরত আবু বকর (রা) জিজ্ঞাসা করিলেন, “হযরত মোহাম্মদ (সা) কোন দিন ইন্তেকাল করিয়াছিলেন?” বলা হইল, সোমবার দিন। তখন তিনি বলিলেন, আমার আকাঙ্ক্ষা যেন আজই আমি বিদায় হই। যদি আল্লাহ আমার এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন, তবে আমাকেও রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পবিত্র কবরের নিকটে সমাহিত করিও।


ধীরে ধীরে শেষ নিঃশ্বাসের সময় নিকটবর্তী হইতেছিলেন। হযরত আয়েশাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হযরত মোহাম্মদ (সা)-কে কয়টি কাপড়ে কাফন দেওয়া হইয়াছিল? আয়েশা (রা) বলিলেন, তিন কাপড়ে। তিনি বলিলেন, আমাকেও তিন কাপড়ে কাফন দিও। এখন আমার শরীরে যে দুইটি চাদর আছে এইগুলি ধুইয়া দিও, আর একটি কাপড় বাহির হইতে ব্যবস্হা করিও। হযরত আয়েশা (রা) সমবেদনার সুরে নিবেদন করিলেন,- “আব্বাজান! আমরা এত দরিদ্র নই যে, নতুন কাফন কিনিতে সমর্থ হইব না।”হযরত আবু বকর (রা) বলিলেন, “কন্যা, মৃতদের চাইতে জীবিতদের কাপড়ের বেশী প্রয়োজন। আমার জন্য এই পুরাতন কাপড়ই যথেষ্ট হইবে।”


মৃত্যুর মুহূর্ত একটু একটু করিয়া নিকটবর্তী হইতেছিল। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা) এই অস্তাচলমুখী চাঁদের শিয়রে বসিয়া অশ্রু বিসর্জন করিতেছিলেন। দুঃখ বেদনায় ভরা এক একটি কথা তাঁহার কণ্ঠনালী হইতে অশ্রুর বন্যার সহিত ভাসিয়া আসিতেছিল। বসিয়া বসিয়া তিনি কবিতা আবৃত্তি করিতেছিলেন- যাহার মর্ম হইল-


“জ্যোতিষ্কের মতো এমন অনেক উজ্জ্বল চেহারাও রহিয়াছে, যাহার নিকট মেঘমালাও পানি ভিক্ষা করিত; তিনি ছিলেন এতিমদের আশ্রয়স্থল এবং বিধবাদের পৃষ্ঠপোষক।”


কবিতা শুনিয়া হযরত সিদ্দিক (রা) চক্ষু খুলিলেন এবং বলিতে লাগিলেন, “বৎস, এই কথা একমাত্র রসূলুল্লাহ (সা) সম্পর্কেই খাটে।” হযরত আয়েশা (রা) দ্বিতীয় একটি কবিতা আবৃত্তি করিতে লাগিলেন, যাহার মর্ম হইল-


“তোমার বয়সের শপথ, মৃত্যুর ঊর্ধ্বশ্বাস যখন আসিয়া উপস্থিত হয়, তখন ধন-সম্পদ কোন কাজে আসে না।”


হযরত আবু বকর (রা) বলিলেন, এই কথা বল-


جَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ۖ ذَٰلِكَ مَا كُنتَ مِنْهُ تَحِيدُ


-“মৃত্যু যন্ত্রণার সঠিক সময় আসিয়া উপস্থিহ হইয়াছে, উহা ঐ সময় যাহা হইতে তোমরা পলাইতেছিল।”- (কোরআন)


হযরত আয়েশা (রা) বলেন, মৃত্যুর সময় আমি আমার পিতার শিয়রে বসিয়া নিম্নের মর্ম সম্বলিত কবিতাটি আবৃত্তি করিয়াছিলাম-


“যাহার অশ্রু সর্বদা, বদ্ধ রহিয়াছে একদিন তাহাও প্রবাহিত হইবে। প্রত্যেক আরোহীর কোন না কোন গন্তব্যস্থান রহিয়াছে। প্রত্যেক পরিধানকারীকেই কাপড় দেওয়া হইয়া থাকে।!”


ইহা শুনিয়া আমর পিতা বলিতে লাগিলেন, কন্যা, এই ভাবে নয়, সত্য কথা এইরূপ যেইরূপ আল্লাহ বলিয়অছেনঃ


جَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ۖ ذَٰلِكَ مَا كُنتَ مِنْهُ تَحِيدُ


মৃত্যু যন্ত্রণার সময় উপস্থিত হইয়াছে, উহা ঐ নিদারুণ সময় যাহা হইতে তোমরা পলায়ন করিতে।ইন্তেকাল


এই কথা বলিতে বলিতে হযরত আবু বকরের পবিত্র জীবনের সমাপ্তি হইয়াছিল-


رَبِّ تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ

- “হে আল্লাহ, আমাকে মুসলমান হিসাবে মৃত্যু দাও এবং তোমার সৎ বান্দাদের সহিত মিলিত কর।”


হিজরী ১৩ সনের ২৩ জুমাদাল আখের সোমবার দিন এশা ও মাগরেবের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁহার পবিত্র রূহ এই পাপ দুনিয়া হইতে উঠিয়া যায়। এই সময় তাঁহার বয়স হইয়াছিল ৬৩ বৎসর। তাঁহার খেলাফত ছিল দুই বৎসর তিন মাস এগার দিন।


স্ত্রী হযরত আসমা বিনতে উমাইস (রা) গোসল দেন। আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর শরীরে পানি ঢালিয়া দেন। হযরত ওমর জানাযার নামায পড়ান। রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পবিত্র সমাধিঘর সংলগ্ন স্থানে কবর খনন করা হইল।


রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের স্কন্ধ বরাবর মাথা রাখিয়া হযরত আবু বকর (রা)-এর কবর রচনা করা হয়। হযরত ওমর, হযরত তালহা, হযরত ওসমান এবং হযরক আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা) পবিত্র লাশ কবরে নামাইলেন। এইভাবে রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের পর উম্মতের সবচাইতে জনপ্রিয়, সর্বজনমান্য ব্যক্তিকে দুনিয়ার আকাশ হইতে চিরতরে ডুবাইয়া দেওয়া হইল। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।

Comments

Popular posts from this blog

শরীয়তে ছুন্নাহর স্থান

রাসূল (স) এর দাওয়াত ও দাওয়াতের উদ্দেশ্য

হযরত ওস্‌মানের শাহাদাত