ইসলামী সাহিত্যের নিদর্শন

রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের জীবন থেকে একথা প্রমাণিত যে, ইকামাতে দ্বীনের কাজ সব ফরযের বড় ফরয। এ কাজের জন্যই আল্লাহ পাক রাসূল পাঠিয়েছেন বলে কয়েকটি সূরায় ঘোষণা করেছেন।
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ
‘তিনিই সে সত্তা, যিনি তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও আনুগত্যের একমাত্র সত্য বিধানসহ পাঠিয়েছেন, যেন রাসূল (সা.) তাকে (বিধানকে) আর সব রকমের আনুগত্যের বিধানের উপর জয়ী করেন।’ (সূরা তাওবা ৩৩, সূরা ফাত্হ ২৮ ও সূরা সফ ৯ আয়াত)
এ বিরাট কাজটি এমন যে নবীর পক্ষেও এ কাজ একা করা সম্ভব নয়। তাই এ কাজের জন্য একদল যোগ্য লোক তৈরি করার প্রচেষ্টা সকল নবীই করেছেন। যে নবী প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক পাননি তাঁর হাতে ইসলাম বিজয়ী হয়নি বা দ্বীন কায়েম হতে পারেনি।
এ দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, ইকামাতে দ্বীনের জন্য মুসলিমদের জামায়াত বা সংগঠন অপরিহার্য। অর্থাৎ ইকামাতে দ্বীনের এ বড় ফরয কাজটির জন্য জামায়াতবদ্ধ হওয়াও ফরয। এভাবেই জামায়াতবদ্ধ হওয়া দ্বিতীয় বড় ফরয। বাইয়াতই হল জামায়াতী বন্ধনের সূত্র। তাই ইকামাতে দ্বীনের জন্য বাইয়াত ছাড়া উপায় নেই। প্রকৃত কথা এই যে, ঐ বাইয়াতই আসল ইসলামী বাইয়াত যা ইকামাতে দ্বীনের উদ্দেশ্যে ইসলামী সংগঠনের মধ্যে চালু হয়।
মুসলমানদের যেসব সংগঠনে বাইয়াত পরিভাষাটি ব্যবহার করা সত্ত্বেও ইকামাতে দ্বীনের কোন কর্মসূচী ও কর্ম তৎপরতা নেই, সেখানে বাইয়াতের আসল হাকিকাত নেই। নামায, রোযা ও যিকিরের মতো ইসলামে বহু পরিভাষা যেমন মুসলিমদের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও এ সবের হাকিকাত চর্চা খুব কমই হয়েছে, তেমনি বাইয়াত পরিভাষাটির অবস্থাও তাই হয়ে আছে।
প্রকৃত পক্ষে বাইয়াত পরিভাষাটির দ্বারা এমন ইসলামী সংগঠনই বুঝায় যা জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ এর উদ্দেশ্যেই গঠিত। রাসূল (সা.)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত সাহাবায়ে কেরামের জামায়াতই এর আদর্শ নমুনা। বাইয়াতই ঐ জামায়াতের প্রাণ শক্তি।
সূরা তাওবার ১১১ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা একথাই বলেছেন যে, তিনি ঐ সব মু’মিনের জান ও মালই খরিদ করেছেন ‘যারা আল্লাহর পথে লড়াই করে, দুশমনকে মারে এবং নিজেরাও নিহত হয়।’ দ্বীনে হককে কায়েমের আন্দোলন ছাড়া বাতিলের সাথে এ লড়াই হবার কোন কারণই নেই। সুতরাং কুরআন পাকে যে বাইয়াতের কথা বলা হয়েছে তা জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহর উদ্দেশ্যেই। ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলনের জন্যই বাইয়াত দরকার। আর বাইয়াতের মাধ্যমেই জামায়াতবদ্ধ হতে হয়। জামায়াতবদ্ধ না হয়ে ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।
ইকামাতে দ্বীন এর সাথে জামায়াত ও বাইয়াতের সম্পর্ককে নামায ও ওযুর সম্পর্কের সাথে তুলনা করা যায়। আল্লাহ পাক নামাযের জন্যই ওযুকে ফরয করেছেন। নামাযই হল আসল ফরয। ঐ ফরযটি ওযু ছাড়া হয়না বলেই ওযু ফরয। তেমনিভাবে জামায়াত ও বাইয়াত ছাড়া ইকামাতে দ্বীনের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। ইকামাতে দ্বীনই আসল ফরয। ঐ ফরযের প্রয়োজনেই জামায়াত ফরয আর বাইয়াতের বন্ধন ছাড়া জামায়াত মজবুত হতে পারে না এবং জামায়াতের উদ্দেশ্যও পূর্ণ হতে পারে না। অর্থাৎ জামায়াতবদ্ধ হবার ফরযটি বাইয়াতের মাধ্যমেই আদায় হয়।
কেউ যদি ওযূ করে কিন্তু নামায আদায় করার প্রয়োজন মনে না করে তাহলে সে ওযুর কোন সওয়াব পাবে না। সে ওযু করছে না বলে হাত মুখ ধুয়েছে বলাই উচিত হবে। যে নামাযের ধার ধারে না সে ওযুর অঙ্গগুলো ওযুর মতো ধুয়ে নিয়েছে বলেই সে অযু করেছে বলা ঠিক হবে না। কারণ নামাযী লোকই ওযু করে থাকে এবং সে নামাযী নয় বলে ওযু করেনি মনে করতে হবে।তেমনিভাবে ইকামাতে দ্বীনের উদ্দেশ্য ছাড়া যে বাইয়াত তা আসল বাইয়াত নয়। ইসলামে বাইয়াতের যে হাকিকাত তা এ বাইয়াতে পাওয়া যায় না। তবুও বাইয়াত পরিভাষাটি যেভাবেই চালু থাকুক তা সমাজে বেঁচে আছে বলেই এর আসল হাকিকাত চর্চা কাজে লাগতে পারে। যদি বাইয়াত কথাটি লোকের নিকট পরিচিতই না থাকতো তাহলে এর মর্ম বুঝানো আরও কঠিন হতো। যেমন সমাজে যদি নামাযের প্রচলন না থাকতো তাহলে নামাযের হাকিকাত চর্চা করা আরও মুশকিল হতো।
আসল বাইয়াত আল্লাহর নিকট
হুদায়বিয়াতে সাহাবায়ে কেরামের নিরস্ত্র অবস্থা ও কুরাইশদের সাথে লড়াই-এর শপথ করার ঘটনাকে সূরা আল ফাত্হে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে :
إِنَّالَّذِينَيُبَايِعُونَكَإِنَّمَايُبَايِعُونَاللَّـهَيَدُاللَّـهِفَوْقَأَيْدِيهِمْ
‘হে রাসূল যারা আপনার নিকট বাইয়াত হয়েছে তারা নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট বাইয়াত হয়েছে। তাদের হাতের উপর আল্লাহর হাত রয়েছে।’ (সূরা আল ফাত্হ: ১০ আয়াত)
মুমিনের জান ও মাল আল্লাহর নিকট বিক্রয় করার পর তা মু’মিনের হাতেই আমানত রাখা হয়। তাই মু’মিন সে আমনত ইসলামী সংগঠনের মাধ্যমে দ্বীনের পথে কাজে লাগায়। এভাবে কাজে লাগানোকে আল্লাহ তায়ালা কিভাবে গ্রহণ করেন তা এ আয়াতে প্রকাশ পেয়েছে।আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যখন মু’মিন তার জীবন উৎসর্গ করার কথা সংগঠনের নেতার নিকট ঘোষণা করে তখন সে ঘোষণা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই নিকট করা হয়। হুদায়বিয়ার ঐ শপথ রাসূল (সা.)-এর নিকট যেভাবে করা হয়েছে তা যেন আল্লাহরই নিকট করা হলো। তাই তাঁরা যখন রাসূল (সা.)-এর হাতে হাত দিয়ে শপথ করছিলেন তখন আল্লাহর হাতেই যেন হাত দিয়ে শপথ করেছিলেন। তখন আল্লাহর হাতেই যেন হাত দিয়েছিলেন। জিহাদ ও ইকামাতে দ্বীনের উদ্দেশ্যে বাইয়াত হলে তা আসলে আল্লাহরই নিকট হয়ে থাকে।
জামায়াতে ইসলামীর রুকনগণ শপথ গ্রহণের সময় যেসব কথা উচ্চারণ করেন তাতে নিম্নলিখিত আয়াতটিও রয়েছে :
قُلْإِنَّصَلَاتِيوَنُسُكِيوَمَحْيَايَوَمَمَاتِيلِلَّـهِرَبِّالْعَالَمِينَ
‘আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য।’ (সূরা আল আনআম ১৬২)
এ আয়াতের মাধ্যমে যে বাইয়াত নেয়া হয় তা আসলে আল্লাহ পাকের নিকটই বাইয়াত করা হয়।
Comments
Post a Comment